রোজার তাৎপর্য ও ফজিলত | Benefits Of Ramadan
রোজা রাখার মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট শারীরিক উপকারিতা। বিশেষ করে বছরে এক মাস অভুক্ত থাকলে তা স্বাস্থ্যরক্ষায় বেশ ভূমিকা রাখে। এ জন্য প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম মানুষের উচিত রোজা রাখার অভ্যাস করা।এই বিষয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।
হার্ট ভালো থাকে:
রোজা দেহের অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়। এতে রক্তনালিতে জমে থাকা চর্বির উপাদানগুলো কমতে থাকায় হার্ট ব্লকের মতো ঝুঁকি কমে যায়। তাই যাঁদের ওজন বেশি, যাঁদের রক্তে চর্বির পরিমাণ বা কোলেস্টেরল লেভেল বেশি, তাঁরা রোজা রেখে শারীরিক ওজন কমানোসহ নানা উপকার পেতে পারেন। এতে শরীরের চর্বি এবং মেদ-ভুঁড়ি কমানো যায়, যদি না ইফতার ও সাহরিতে মাত্রাতিরিক্ত গুরুপাক, তৈলাক্ত খাবার খাওয়া হয়।
মস্তিষ্কের কার্যক্রম বৃদ্ধি:
রোজা মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিক খাদ্য গ্রহণে শরীরের ওপর যেমন চাপ বৃদ্ধি পায়, তেমনি এই চাপ মস্তিষ্কের ওপরও পড়ে। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, রোজার মাধ্যমে যে মানসিক পরিবর্তন আসে, তাতে মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের নিউরোট্রিফিক ফ্যাক্টর নিসৃত হয়, যা অধিক নিউরন তৈরিতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হয়:
গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য রোজা যথেষ্ট উপকারী। কারণ রোজা রাখা অবস্থায় দেহে নানা ধরনের ইনসুলিন তৈরি হয়, যা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বেশ উপকারী।
কিডনি ভালো থাকে:
কিডনির মাধ্যমে শরীরে প্রতি মিনিটে এক থেকে তিন লিটার রক্ত সঞ্চালিত হয়। কিডনির কাজ হলো শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো প্রস্রাব আকারে মূত্রথলিতে প্রেরণ করা। রোজা অবস্থায় কিডনি বিশ্রাম পায়। ফলে এ সময় কিডনি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
লিভারের ওপর প্রভাব:
রোজার সময় সাহরিতে যে খাবার গ্রহণ করা হয়, তা থেকে ও লিভারে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন থেকে সারা দিনের উপোসের সময় রক্তে প্রয়োজনীয় খাদ্য-উপাদান সঞ্চালিত হয়। লিভারের গ্লাইকোজেন স্টোরেজ শেষ হয়ে গেলে লিভার ও অ্যাডিপোজ টিস্যুতে জমা চর্বি বিপাকের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। ফলে রমজানে একজন রোজাদারের জন্য লিভারের ফ্যাট ও শরীরের বাড়তি ওজন কমার সুযোগ তৈরি হয়। যাঁদের লিভারে ফ্যাট জমা হয়েছে, তাঁদের জন্য রোজা রাখা উত্তম।
ধূমপান ছেড়ে দেওয়া যায়:
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে ধূমপান ছাড়তে পারেন না। তাঁদের জন্য রমজান মাস উত্তম সময়। এই মাসে ধূমপানের মতো ক্ষতিকর ও বদ-অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন বা কমিয়ে দিন।
পরিপাক প্রক্রিয়া কার্যকর হয়:
রোজার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিবারণ হয় না; বরং ধীরে ধীরে ক্ষুধার প্রশিক্ষণ হয়। ফলে রমজান শেষে ক্ষুধার মাত্রাও কমে আসে। খাদ্যনালির পরিপাক প্রক্রিয়া আরো কার্যকর হয়ে ওঠে, খাদ্যদ্রব্য থেকে বেশি পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ সম্ভব হয়।
তাছাড়া রোজা রাখার ফলে আগের চেয়ে আরো দক্ষভাবে কাজ করতে শুরু করে পাকস্থলী। সবল হয় হজমযন্ত্র। ইফতারে পুষ্টিকর উপাদানগুলোকে খুব সহজেই গ্রহণ করে শরীর। অ্যাডিপোনেকটিন নামের হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা মাংসপেশিগুলোকে খাবার থেকে আরো বেশি পুষ্টিকর উপাদান শোষণে সক্ষম করে তোলে।
জটিলতা এড়ানো যায়:
রোজা একজন মানুষের শুধু পাকস্থলী বা হৃৎপিণ্ডকে সক্রিয়ই রাখে না; বরং অন্য অনেক রোগের জন্যও উপকারী। বিশেষ করে রোজার সময় ধূমপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন বন্ধ থাকে বিধায় ক্যান্সার, হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোকের মতো জটিল রোগগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তাই যাঁদের শারীরিক সামর্থ্য ও ইচ্ছা রয়েছে, তাঁরা রমজান মাসের রোজাগুলো নিয়মমতো রাখতে পারেন।
ওজন কমাতে সাহায্য করে:
বাড়তি ওজন যাদের, তারা এইসময়ে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। যেহেতু এইসময় মানুষ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে, সকাল এবং সন্ধ্যেয় স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করে, যেমন- স্যুপ, রুটি, খেজুর এবং অন্যান্য ফল, যা দ্রুত ওজন হ্রাস করতে সহায়তা করে। চিনি এবং চর্বিযুক্ত খাবার এড়ানো হয় বদলে তাজা ফল, তাজা শাকসবজি এবং পানি গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ওজন হ্রাস হয়।
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে:
রমজানে রোজা রাখার অন্যতম সুবিধা হলো এটি আপনার রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। রোজা আপনার গ্লুকোজকে ভেঙে দেয় যাতে শরীর শক্তি পেতে পারে যা ইনসুলিনের উৎপাদন হ্রাস করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে:
রোজা এথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে। দেহ খাদ্য এবং পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরেও শরীরে সঞ্চিত ফ্যাট শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রোজার সময় বিপাকের হারও হ্রাস পায়। অ্যাড্রিনালিন এবং ননঅ্যাড্রিনালিন হরমোনগুলির ক্ষরণও হ্রাস পায়; এটি বিপাকের হারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে, যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পেশীশক্তি সংরক্ষণ করে:
আপনার পেশীগুলিতে সঞ্চিত ফ্যাট ব্যবহৃত হবে। আপনি যখনই কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন, তখন গ্লাইকোজেন (ফ্যাট সেল) যুক্ত হয়, যা ওজন বাড়িয়ে তোলে। তবে রমজানের রোজার সময় ফ্যাট কোষগুলি শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে:
রোজার সময় মানুষ সাধারণত সেহরি ও ইফতারে মাঝে স্বাস্থ্যকর খাবার খায়। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, টক্সিন নির্মূল করতে এবং চর্বি হ্রাস করতে সহায়তা করে। রোজা ভাঙার জন্য যখন খেজুর এবং ফল খাওয়া হয় তখন এগুলি শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজগুলির সঞ্চয় বাড়ায়। ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ই সমস্ত ফলের মধ্যে উপস্থিত, যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
প্রদাহ দূর করে:
রমজানে রোজা রাখার আরেকটি শারীরিক সুবিধা হলো এটি প্রদাহজনিত রোগ এবং অ্যালার্জির সারাতে সহায়তা করে। প্রদাহজনিত রোগের কয়েকটি উদাহরণ হলো- আর্থারাইটিস এবং ত্বকের রোগ যেমন সোরিয়াসিস। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, রোজার ফলে আলসারেটিভ কোলাইটিসের মতো প্রদাহজনক পেটের রোগ নিরাময়ের উন্নতি হতে পারে।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে:
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজা কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের জন্য উপকারি। এই প্রোটিনগুলো মস্তিষ্কের স্টেম সেলগুলো সক্রিয় করতে সহায়তা করবে যাতে তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এই কারণেই আপনি যখন রোজা রাখেন তখন আপনার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে যায়।
মানসিক স্বচ্ছতা দেয়:
রমজানের সময় রোজার আরেকটি মানসিক সুবিধা হলো এটি আপনার শরীরকে খাদ্য এবং পানীয়ের প্রতি কীভাবে আপনার আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়ন্ত্রণ করবেন তা শেখার জন্য প্রস্তুত করে। এই প্রক্রিয়াতে, মস্তিষ্ক সেই অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয় এবং কীভাবে আরও ধৈর্যশীল হতে হয় তা শেখায়।