আমাদের খাবারই আমাদের অসুস্থ্যতার কারণ ! Leave a comment

খাবার তো আমরা সব সময়ই খাই, সব খাবারই কি শরীরের জন্য উপকারি ? সুস্থ থাকতে যেসব পুষ্টি উপাদান দরকার, তা কেবল ‘নিরাপদ খাবার’ থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। শুধু সঠিক খাবার নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি। আর এটি বৃদ্ধি পেলে যেকোনো রোগ–জীবাণুর বিরুদ্ধের লড়াই করা সম্ভব হবে। তাই শরীরের ‘ফাইটিং মোড’ সচল রাখতে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই কিছু পুষ্টি উপাদান রাখতেই হবে। এ জন্য প্রথমেই আমরা কি খাচ্ছি এবং সেটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু দরকারি, সে খাবার থেকে কতটুকু পুষ্টি অথবা শক্তি পাব সেটি ভাবতে হবে। কারণ খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এই তিনটি শব্দ একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে একজন ব্যক্তির জন্য সুষম খাদ্য নিবার্চন, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া অথৈর্নতিক অবস্থা, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির ওপরও পুষ্টি অনেকটাই নিভর্র করে।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রধান চাহিদাটা হলো খাদ্য। সুস্থ, সুন্দর আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে খাদ্য মানুষ খায়, সেই খাদ্য ভেজালবিহীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দিনের পর দিন ভেজাল খাদ্য খেয়ে জটিল ও মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশজুড়েই চলছে এই ভেজাল উৎসব। ক্রেতা অধিকার সম্পর্কে দেশের মানুষের অজ্ঞতা, ভেজালবিরোধী আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে দেশের একটি চক্র অধিক মুনাফার আশায় দিনের পর দিন খাদ্যে ভেজাল দিয়ে জনজীবনকে তথা জাতিকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

খাদ্যের কয়েকটি উপাদান যেমন- শকর্রা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই হলো সুষম খাবার। শকর্রা শরীরে শক্তি ও কাযর্ক্ষমতা জোগায়। চাল, গম, যব, আলু, মিষ্টি আলু, কচু, চিনি, মধু, গুড় ইত্যাদিতে প্রচুর শকর্রা পাওয়া যায়। প্রতিগ্রাম শকর্রা থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রোটিন হলো দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরণকারী খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ডাল, বরবটি, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি দেহ গঠনে সহায়তা করে। প্রতিগ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। চবির্ বা ফ্যাট দেহের কমর্দক্ষতা বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর ও মসৃণ রাখে। সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ঘি, মাখন, চবির্যুক্ত মাছ, মাংস, ডিম ও কলিজা ইত্যাদি চবির্যুক্ত খাদ্য। প্রতি গ্রাম চবির্ থেকে ৯ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। পানি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। দিনে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা দরকার।

এ ছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা দরকার। আশঁ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রনালির সুস্থতা বজায় রাখে। খাদ্যের আঁশ উদ্ভিজ খাদ্য থেকে পাওয়া যায়। যেমন-লাল আটা, যব, ভুট্টা, যবের ছাতু, শিম, শিমের বিচি, ডাল ও ডালজাত খাদ্য, খোসাসহ ফল যেমন-কালোজাম, আঙুর, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি ও সব ধরনের শাক-সবজি। খনিজ লবণ যেমন-ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক যা দেহ গঠন, ক্ষয় পূরণ, পরিপোষণ, দেহের শরীরবৃত্তীয় কাজ করে। আয়োাডিন গলগন্ড রোগ প্রতিরোধ করে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে; হাত ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। জিংক মানসিক বৃদ্ধি ও হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ভিটামিন এ, ডি, ই, কে, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সি-সব রকমের সবুজ ও রঙিন শাক-সবজি, ফল, টকজাতীয় ফল, ডিম, দুধ, কলিজা, ছোট মাছ, লেবু চা ইত্যাদি খাদ্যে ভরপুর এবং রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘ডি’ রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ত্বকের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’ স্কাভির্ রোগ প্রতিরোধ করে।

আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। শিশুর জন্য জন্মের ৬ মাস পযর্ন্ত মায়ের দুধই যথেষ্ট এবং ৬ মাস থেকে ২ বছর পযর্ন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি আথির্ক সামর্থ অনুযায়ী অধিক পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন করা হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু, মা ও বৃদ্ধরা পরিবারের জন্য অথৈর্নতিক ও মানসিক বিপযর্য় ডেকে আনে। শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে পেটের অসুখ, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি না ঘটার কারণে আত্মকেন্দ্রিকতা, অবসাদ, ব্যক্তিত্বহীনতা দেখা যায় এবং মেধাশক্তি বিকশিত হতে পারে না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে অলস ও উদাসীন, পরনিভর্র নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে।

সঠিক রান্নার পদ্ধতি, নিদির্ষ্ট সময়ে খাওয়া ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা সবই স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকে প্রভাবিত করে। মারাত্মক পুষ্টিহীন শিশুদের শুধু ডাল, আলু, সবুজ তেল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খাইয়ে অতি অল্পসময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। শিশুর পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ন্ত ও কৈশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রেই পরিবতর্ন চুড়ান্ত। তাই পুষ্টির চাহিদাও এ সময়ের পরিবতের্নর ওপর নিভর্রশীল। এ বয়সে মেয়েদের অপুষ্টি বেশি দেখা যায়। কিশোর-কিশোরীদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ক্যালোরির চাহিদা পূরণ করতে হয়। পরিমিত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, বিশুদ্ধ পানি, নিয়মিত শারীরিক শ্রম, বিশ্রাম, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও নজর দিতে হবে।

মায়ের পুষ্টি শিশুর তুষ্টি। অথার্ৎ সুস্থ ও স্বাস্থ্যবতী মা-ই কেবলমাত্র স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দিতে পারে। পুষ্টিহীন মায়ের সন্তানের জন্মকালীন ওজন কম এবং অসুস্থ, হাবাগোবা, রুগ্ণ হয়ে জন্মায়। পরে নানা রোগে ভোগে। প্রসূতি মায়েদেরও নানা রকম জটিলতা দেখা যায়। গভর্বতী ও স্তন্যদাত্রী অবস্থায় মায়েদের খাবারের প্রয়োজন সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশি থাকে। এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন, জিংকসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। অনেক সময় পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে পুষ্টির অভাবে নিজের চাহিদার ঘাটতির সঙ্গে সন্তানও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ঘাটতি নিয়ে জন্মায়। মাকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন রঙিন শাকসবজি, ফল, টকজাতীয় ফল, পানি ও পানিজাতীয় খাবার প্রয়োজন অনুযায়ী খেতে হবে। তা ছাড়া এ সময় চিন্তামুক্ত ও আনন্দভাব নিয়ে থাকতে হবে। অনেক সময় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা মায়ের অপুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সেও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পুষ্টির চাহিদা রয়েছে। বয়স বাড়লে খাবারের চাহিদা, হৃৎপিন্ডের কাযর্ক্ষমতা, পরিপাকতন্ত্রের কাযর্ক্ষমতা, চেতনতন্ত্রের কাযর্ক্ষমতা কমে যায়। রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। দাঁত-হাড়ের সমস্যা ও বাত-ব্যাধি দেখা দেয়। এ বয়সে সাদা আটা, চাল, চিনি ময়দা ইত্যাদি খাবার কম খেতে হবে। তেল, চর্বি, লবণ, মিষ্টি ক্যাফেন সমৃদ্ধ খাবারও কম খেতে হবে। এ সময়ে পানি ও পানিজাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। হজমে সহায়ক, কোষ্ঠকাঠিন্যরোধক, বাত ও ওজন নিয়ন্ত্রক খাবার খেতে হবে। লাল আটা, বিভিন্ন আঁশ জাতীয় শাক-সবজি, ফল, চবির্হীন মাছ-মাংস ইত্যাদি খাবার খেতে হবে। প্রয়াজনে নিয়মিত হাটতে হবে। না হলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, বাত, চোখের রোগ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। বয়স চল্লিশের পর থেকে ডিমের কুসুম, ঘি, মাখন, অতিরিক্ত চবির্যুক্ত মাছ, মাংস, শকর্রাজাতীয় খাওয়া কমাতে হবে। বৃদ্ধবয়সে ক্যালসিয়াম ও লৌহের অভাব বেশি দেখা যায়। সর তুলে দুধ, দুধের তৈরি খাবার, পনির, পায়েস ইত্যাদি খাওয়া যায়। পুষ্টির সমস্যার জন্য অজ্ঞতা ও অসেচতনতাও দায়ী। বাজারের টিন ও প্যাকেটজাত খাবার থেকে বাড়িতে তৈরি খাবার অনেক বেশি পুষ্টিকর। যে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা যত ভালো, সে দেশ তত বেশি উন্নত। সুষম পুষ্টিকর খাবারই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে।

বতর্মানে শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে গ্রাম পর্য়ায়ে জনগণও অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। সেই সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির ফলে গ্রামে টেলিভিশনের প্রাপ্যতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় রেডিও ছিল গ্রামের মানুষের তথ্য প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। রেডিও শুধুমাত্র শ্রবনযোগ্য একটি যোগাযোগের মাধ্যম। সেই বিবেচনায় টেলিভিশন অধিকতর প্রভাবশালী একটি গণমাধ্যম কারণ এতে একই সাথে শোনা ও দেখা যায়। তাই টেলিভিশনে দেখানো একটি তথ্যেও প্রভাব মানুষের ওপর বেশি পড়ে। আর দৈনিক পত্রিকা সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তথ্য প্রদানের একটি বিশ্বাসযোগ্য ও গুরুত্বপূণর্ মাধ্যম হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। যেহেতু বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ তাই আমাদের এখন পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূণর্তার দিকে বিশেষ বিবেচনা দেয়া উচিত।

সার্বিকভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত হলেও পুষ্টি নিরাপত্তার দিক থেকে পিছিয়ে আছে। অথচ, বাস্তবে আমরা দেখছি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের জন্য খাদ্যের এ সব উপাদান বহনকারী মাছ, মাংস, ডিম, ফল, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায় চলে এসেছে। অর্থাৎ সুষম খাদ্যের ছয়টি প্রধান উপাদান কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানির কোনোটিরই তেমন অভাব দেখছি না। তাই স্বীকার করতেই হবে সুষম খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের জানার অভাব রয়েছে এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে অনীহা আছে। আমরা যখন খাদ্য গ্রহণ করি তখন পুষ্টিকর কি না, তা চিন্তা না করে মুখোরোচক হলো কি না, তাতে বেশি গুরুত্ব দেই। এজন্য দেখা যাচ্ছে হাতের কাছে অনেক পুষ্টিকর খাবার থাকার পরেও আমাদের সচেতনতার অভাবে তা গ্রহণ করি না। এছাড়া আমাদের রন্ধনপ্রণালির মধ্যেও পুষ্টিমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।

আশার কথা সম্প্রতি বাংলাদেশ পুষ্টি পরিস্থিতির ক্ষেত্রে অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেমন- পুষ্টিহীনতার প্রবণতা ক্ষুধা পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত সূচকের হার ১৯৯৯- ২০০১ সময়ে গড়ে ২০ দশমিক ৮ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৭-১৯ সময়ে গড়ে ১৩ তে উপনীত হয়েছে। একইভাবে ২০০৪ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে খর্বতার (stunting) হার ৫১ শতাংশ থেকে কমে ২৮ শতাংশ এবং কৃশকায়তায় শতকরা ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কম ওজনের শিশুর হার ৪৩ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি ২০২০ প্রণয়ন করেছে।

সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যৌথভাবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করে যা বর্তমানে দেশের ১০৪টি উপজেলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ৩২ দশমিক ৩৮ লাখ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। জাতীয় স্কুল মিল্ক নীতিমালা ২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে যার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় গমন উপযোগী শিশুদের পুষ্টির মান উন্নয়নে অবদান রাখবে আশা করা যায়। নিঃসন্দেহে এগুলো সাম্প্রতিককালে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাস্তব পদক্ষেপ এবং সফলতার পরিচয় বহন করে।

তবে এখানে আÍতুষ্টির কিছু নেই। পুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স (FSI) এবং গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে (HI) বাংলাদেশের অবস্থান ইতিপূর্বে যা তুলে ধরেছি তাতে আমাদের এই অবস্থান থেকে উত্তোরণের জন্য আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে।

সার্বিকভাবে অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে:

১। বাংলাদেশের ডায়েটে প্রোটিনের স্বল্পতা অত্যন্ত দৃশ্যমান। বিশেষ করে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই তাদের প্রোটিন সরবরাহের জন্য মাছ-মাংসের পাশাপাশি মাশরুম, বিভিন্ন ধরনের ডাল, বাদাম ইত্যাদি খাবার হিসেবে গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশি­ষ্ট বিভাগের সম্প্রসারণ কর্মীগণ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।

২। অনেক প্রতিষ্ঠান পুষ্টিহীনতা নিয়ে কাজ করছে, তবে পুষ্টি কার্যক্রমে অবদান রাখার জন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসা উচিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফর্টিফাইড রাইস যেখানে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে তা সাধারণ মানুষের কাছে এখনো ততটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। তাই ফর্টিফাইড রাইস বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে।

৩। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা থেকে দরিদ্র মানুষকে রক্ষা করার জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চাল ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

৪। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি কমানোর জন্য শাকসবজি একটা অনন্য ভ‚মিকা পালন করে থাকে। জমির যেহেতু স্বল্পতা রয়েছে তাই ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ের দিকে নজর দিতে হবে। যাতে বসতবাড়িসহ নিজস্ব জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়।

৫। পুষ্টিযুক্ত শিশুখাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে প্রত্যেকটি পরিবারকে সচেতন করার পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

৬। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি বহুমুখীকরণ, টেকসইভাবে কৃষি নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ এবং পুষ্টি কার্যক্রমসমূহের প্রকল্পে উন্নত ও জলবায়ু উপযোগী প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে মাঠ পর্যায়ের সম্প্রসারণ ও অভিযোজন করা প্রয়োজন।

৭। পুষ্টি সংবেদনশীল খাদ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা করার জন্যে দুর্বল বিপণন অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করা অতি জর“রি।

৮। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ অভিযোগ প্রতিকারের বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধান করা।

৯। সর্বোপরি নিরাপদ ও গুণাগুণসম্পন্ন খাদ্যের ব্যাপক প্রচারের জন্য সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে আরো এগিয়ে আসতে হবে।

খাদ্য উৎপাদনে দেশের ব্যাপক সফলতা সত্ত্বেও প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে বাংলাদেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। উপরন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতসহ কিছু নেতিবাচক প্রবণতা, ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষি প্রসারে বর্তমানে চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে এমন আশঙ্কা আছে। তাই সরকারের সংশি­ষ্ট মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সহযোগী ও সব অংশীজনের সমন্বয়, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি চাহিদা প্রচেষ্টায় সংশি­ষ্ট সবাইকে আরো জোরদার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকার সুষম খাবার, খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে যে জোর দিয়েছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব একমাত্র সাধারণ জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে। জাতীয় গণমাধ্যমগুলো সাধারণ জনগণের মধ্যে পুষ্টি বিষয়ক এই তথ্যসমূহ যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে সঠিক যোগাযোগের একটি সেতুবন্ধন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

SHOPPING CART

close
Translate »
0
    0
    Your Cart
    Your cart is emptyReturn to Shop